ড. মিহির কান্তি মজুমদার   2021-05-19  
কোভিড টিকার মেধাস্বত্ব: মুনাফা বনাম বিপন্ন মানবতা
করোনা ভাইরাস সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারীতে প্রত্যেকটি দেশের জনজীবন এখন বিপর্যস্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মার্চ ১১, ২০২০ তারিখে এ বৈশ্বিক মহামারীর ব্যাপকতা সম্পর্কে ঘোষণা দেয়। এর মাত্র ১২ মাসের মধ্যে করোনা ভাইরাসের টিকা আবিষ্কার এবং বাস্তব
প্রয়োগ শুরু হয়। এটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিশাল অগ্রগতির এক অনন্য নজির। বিশ্বের অনেক দেশ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান টিকা উদ্ভাবন ও পরীক্ষামূলক কাজে লিপ্ত। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির ফাইজার-বায়োএনটেক, যুক্তরাজ্য ও সুইডেনের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, রাশিয়ার স্পুটনিক, চীনের সিনোভ্যাক্স, সিনোফার্ম (বেইজিং), সিনোফার্ম (উহান) এবং ভারতের কোভ্যাকসিন এ আটটি টিকার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। কিন্তু টিকার এ প্রয়োগের মধ্যেও দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশের মানুষের কাছে এ মহাপ্রতিষেধক থেকে যাচ্ছে প্রায় অধরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীর ৭০% মানুষকে টিকা দেয়ার জন্য ১১০০ কোটি ডোজ টিকা প্রয়োজন। এর মধ্যে ৮৬০ কোটি ডোজ উৎপাদন ও ক্রমান্বয়ে সরবরাহের তথ্য নিশ্চিত হয়েছে। তবে আশঙ্কাজনক তথ্য হচ্ছে এর ৬০০ কোটি ডোজ যাবে উন্নত ও উচ্চ আয়ের দেশে। দরিদ্র ও নি¤œ আয়ের দেশের মানুষের জন্য টিকা সরবরাহের নিশ্চয়তা প্রায় নেই, যেখানে পৃথিবীর ৮০% লোক বাস করে।
টিকা আবিষ্কার ও প্রয়োগ চলছে এ আশার মধ্যেও তাই হতাশার সুর ও মৃত্যুর আশঙ্কা। আশঙ্কার কারণ হচ্ছে মেধাস্বত্ব ও প্রযুক্তি হস্তান্তরে প্রতিবন্ধকতা, আর তাই উন্নয়নশীল দেশের কাছে টিকা না পৌঁছানো। যাকে বলে Vaccine Divide বা টিকা বৈষম্য। কোন আবিস্কারের জন্য উদ্ভাবকের স্বার্থ সংরক্ষণের প্রয়োজনে মেধাস্বত্বের সৃষ্টি। ইতালিতে ১৪২১ সালে সর্বপ্রথম প্যাটেন্ট সম্পর্কিত মেধাস্বত্ব প্রদানের ব্যবস্থা শুরু হয়। ১৯৯৫ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অধীনে TRIPS (Trade Related Aspects of Intellectual Property Rights) এর প্রয়োগ শুরু না হওয়া পর্যন্ত মেধাস্বত্বের আন্তর্জাতিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে খুব একটা বাধ্যবাধকতা ছিল না। এ সময় সকল উন্নত দেশ একে অন্যের প্রযু্িক্ত ও উদ্ভাবন আয়ত্ব করেছে মেধাসত্বের বাধা ছাড়াই। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের অর্থনৈতিক বিপর্যয় উত্তরণে বিশ্ব বাজার ব্যবস্থায় শুল্ক ও অশুল্ক বাধাসহ অন্যান্য বাধা দূরীকরণের জন্য ১৯৪৮ সালে GATT (General Agreement on Tariffs and Trade) প্রতিষ্ঠা করা হয়। GATT নামক চুক্তি থেকে জাতিসংঘের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) নামক একটি প্রতিষ্ঠান ১৯৯৫ সালে জন্মলাভ করে। সে সময় কঠিন শর্তাবলী সম্বলিত মেধাস্বত্বের TRIPS চুক্তি প্রধানত যুক্তরাষ্ট্র ও উন্নত দেশসমূহের প্রভাবে প্রণীত ও স্বাক্ষরিত হয়। মেধাস্বত্ব সম্পর্কিত TRIPS-এর কঠিন শর্তাবলীর কারণেই তৃতীয় বিশে^র দেশগুলোতে টিকা উৎপাদন ও প্রাপ্তিতে আছে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা।
এ কারণে অক্টোবর ০১, ২০২০ তারিখে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বের অধিকাংশ মানুষকে টিকা না দেয়া পর্যন্ত কোভিড টিকার মেধাস্বত্ব সাময়িকভাবে স্থগিত করার জন্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিকট আবেদন করে। বিশ্বের শতাধিক দেশ এ আবেদনে সমর্থন করে। নোবেল পদকপ্রাপ্ত বিজ্ঞানীসহ বিশ্বের ১৭০ জন বিজ্ঞানী টিকার মেধাস্বত্ব সাময়িক স্থগিতকরণ ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য একইভাবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় আবেদন করে। `The People’s Vaccine Alliance’ মেধাস্বত্ব ছাড়ের প্রস্তাবে সমর্থন দেয় এবং সমর্থন আদায়ে সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানসহ অনেক দেশকে অনুরোধ করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রগতিশীল ১০ জন সিনেটর এ টিকার মেধাস্বত্ব সাময়িকভাবে স্থগিতকরণের প্রস্তাবে সমর্থনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মাননীয় প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করেন। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ডিসেম্বর ০৩, ২০২০ তারিখে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ৩১তম বিশেষ অধিবেশনে বৈশ্বিক করোনা মহামারী নিয়ন্ত্রণে ০৩টি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন এবং তা হচ্ছে মানসম্পন্ন টিকা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ন্যায়সঙ্গত সক্ষমতা তৈরি, টিকা উৎপাদনের প্রযুক্তি হস্তান্তর (TRIPS-এর ৬৬.২ ধারা) এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত এপ্রিল ২০, ২০২০ তারিখে একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে একইভাবে করোনা ভাইরাসের টিকাকে মেধাস্বত্ববিহীন ‘Global Public Goods’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া এবং এ বৈশ্বিক মহামারী উত্তরণে সম্মিলিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করেন।
করোনা ভাইরাসের টিকার মেধাস্বত্ব সম্পূর্ণ বা স্বল্পকালীন সময়ে কার্যকর না করার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রবল দাবি ও প্রস্তাব উঠলেও কোন নেই। ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রস্তাব বিগত ০৬ মাসে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার জেনারেল কাউন্সিলে আলোচনা ও সিদ্ধান্তের জন্য উপস্থাপিত হয়নি। বিশ্বের কিছু ধনী দেশ বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, সুইজারল্যান্ড, জাপান, নরওয়ে, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং এমনকি করোনা বিপর্যস্ত ব্রাজিল মেধাস্বত্বের প্রয়োগ স্থগিত রাখার প্রস্তাবের বিরোধিতা করছে। সাথে আছে বিশেষ নামকরা ওষুধ গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং তাদের সংগঠন International Federation of Pharmaceutical Manufactures Associations (IFPMA), আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ও কিছু মেধাস্বত্বের আইনজীবী। তাদের যুক্তি হচ্ছে মেধাস্বত্বের কারণে গবেষক ও বিনিয়োগকারী গবেষণা ও বিনিয়োগে উৎসাহিত হন এবং এ ধারাবাহিকতা প্রজন্মান্তরে গবেষণায় ও নিত্য নতুন উদ্ভাবনে উৎসাহ ও অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করে। মেধাস্বত্ব এখানে সাময়িকভাবে স্থগিত হলে ভবিষ্যতে এরূপ বৈশ্বিক মহামারীর টিকা, ওষুধ বা প্রযুক্তি উদ্ভাবনে আগ্রহ কমবে, যা খুবই মারাত্মক ও আত্মঘাতী হবে।
কি অকাট্য ও অমানবিক যুক্তি! মনে হয় এরূপ মহামারী প্রতি দশকে আসে। চতুর্দশ শতকে বিউবোনিক প্লেগ রোগে (১৩৪৬-১৩৫৩) ০৮ বছরে ইউরোপের প্রায় ২০ কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছিল, যার কারণে একে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। এর টিকার প্রয়োগ শুরু হয়েছে ৫৩০ বছর পরে ১৮৯০ সালে। দ্বিতীয় বৈশ্বিক মহামারী স্প্যানিশ-ফ্লু হানা দিয়েছে ১৯১৮-১৯২০ সময়কালে। বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ লোককে (প্রায় ৫০ কোটি) আক্রান্তকারী এ বৈশ্বিক মহামারীতে প্রায় ০৫ কোটি লোক প্রাণ হারিয়েছে। আর এ স্প্যানিশ-ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়েছে ১৯৪০ সালে। উভয় ক্ষেত্রে কোয়ারেন্টাইন, মাস্ক ও সামাজিক দূরত্বের প্রয়োগ ও কোটি কোটি মানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে এ রোগের মহামারী কমেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অসাধারণ উন্নতির কারণে মাত্র ১২ মাসের মধ্যে টিকা আবিষ্কার ও প্রয়োগ হচ্ছে। অথচ মেধাস্বত্ব ও প্রযুক্তির অভাবে তা সকলের কাছে যাচ্ছেনা, বাড়ছে বৈষম্য ও মৃত্যু। বিপন্ন মানবতার চেয়ে মেধাস্বত্বের মাধ্যমে অর্জিত মুনাফার মূল্য কি অনেক বেশি
TRIPS-এর শর্তাবলী কঠিন হলেও চুক্তির ৩০ ও ৩১ ধারায় কিছু সুযোগ রাখা হয়েছে, যদিও তা বাস্তবায়নে বিঘœ অনেক। যেমন স্বল্পোন্নত দেশসমূহের জন্য ওষুধ প্রস্তুতে জানুয়ারি ০১, ২০৩৩ তারিখ পর্যন্ত মেধাস্বত্বের প্রয়োগ হবে না। একই সঙ্গে চুক্তির ৬৬.২ ধারায় স্বল্পোন্নত দেশে প্রযুক্তি হস্তান্তর করার বিধান আছে। বাংলাদেশ চাহিদার প্রায় ৯৭ ভাগ ওষুধ উৎপাদন করে এবং ১৫০টির বেশি দেশে রপ্তাণি করে। প্রযুক্তি পাওয়া গেলে এদেশেই এ টিকা উৎপাদন করা সম্ভব। কিন্তু প্রযুক্তি সহজে কেউ দেয়না, কারণ ঐ মেধাস্বত্ব ও মুনাফা। TRIPS চুক্তির ৩১ (এফ) ধারায় কোন দেশে জরুরি প্রয়োজনে Compulsory License প্রদান করে মেধাস্বত্বের প্রয়োগ ছাড়াই ওষুধ উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু ভারত ২০১২ সালে Bayer-কর্তৃক উদ্ভাবিত ক্যান্সারের ওষুধ এ পদ্ধতিতে প্রস্তুত করায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল চাপের সম্মুখীন হয়েছিল। TRIPS চুক্তিতে Voluntary License-এর আওতায় পারস্পারিক সম্মতিতে উৎপাদনের সুযোগ আছে। এরূপ চুক্তির মাধ্যমে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা তৈরি করছে। এ ক্ষেত্রে উদ্ভাবকের শর্তাবলী মেনে চলতে হয় এবং এরূপ চুক্তিতে স্বার্থ বা মুনাফার প্রশ্ন বেশি থাকে, মানবতা নয়। ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে সেরাম এখন অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার সাথে চুক্তি বা বাংলাদেশসহ যেসব দেশে টিকা সরবরাহের চুক্তি করেছিল তাদের কাউকে টিকা সরবরাহ করতে পারছে না। বরং নিষেধাজ্ঞা না দিয়ে রাষ্ট্রীয় খরচে সেরামের টিকা উৎপাদন ক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি করে ভারতে ও অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে তাদের টিকা সরবরাহের মহাসুযোগ ছিল। যাহোক, মেধাস্বত্বের প্রয়োগের পাশাপাশি এরূপ নিষেধাজ্ঞাও এখন টিকা সরবরাহে হুমকি। ইতালি কর্তৃক অস্ট্রেলিয়ায় অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা রপ্তানিতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ভারতে টিকার প্রয়োজনীয় উপাদান রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা বা সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকা রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা সবই বিপন্ন মানবতাকে আরও বিপন্ন করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন ইমিউনাইজেশন ও কয়েকটি উদ্যোগী সংস্থার সাথে সৃষ্ট উদ্যোগ “কোভ্যাক্স” ২০০ কোটি ডোজ টিকা ২০২১ সালের মধ্যে সংগ্রহের প্রচেষ্টা নিয়েছে। ইতোমধ্যে ১০০ কোটি ডোজের নিশ্চয়তা পেয়েছে। ইতোমধ্যে ফাইজার কোভিড রোগ নিরাময়ের জন্য ওষুধ তৈরি করেছে, যা এ বছরের শেষে বাজারে আসবে। তবে সে ক্ষেত্রেও সংকট থাকবে- কারণ ওই মেধাস্বত্ব। ইতোমধ্যে বেশিরভাগ দেশে টিকা সংকট শুরু হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী এ সংকট চলতে থাকলে বিশ্বের ৭৫টি দেশ টিকা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারবে, আর ১১৫টি দেশের জনগণকে আক্রান্ত ও মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এ জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডাইরেক্টর জেনারেল জরুরি ভিত্তিতে উন্নয়নশীল দেশে টিকা দ্রুত উৎপাদনের প্রস্তাব করেছেন। এজন্য প্রয়োজন মেধাস্বত্বের কার্যক্রম সাময়িক স্থগিতকরণ ও প্রযুক্তি হস্তান্তর। দুটোরই বিধান আছে TRIPS-এ, কিন্তু প্রয়োগ নেই। সেজন্য কোভিড টিকার মেধাস্বত্ব সাময়িকভাবে স্থগিত করা এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের সক্ষম দেশে টিকা উৎপাদনে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করা খুবই জরুরি।