ড. মিহির কান্তি মজুমদার   2021-05-19  
করোনাভাইরাস কি বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়
করোনা প্রজাতির সপ্তম ভাইরাস, যা SARS-CoV-2 নামে পরিচিত, গত দেড় বছর ধরে সারা পৃথিবীতে তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। সমস্ত পৃথিবীর জনজীবন প্রায় থমকে গেছে। বাড়ছে আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর মিছিল। ইতিবাচক অগ্রগতিও হয়েছে। ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও প্রয়োগ শুরু হয়েছে। কোন রোগের ভ্যাকসিন এত দ্রুত সময়ে সৃষ্টি ও প্রয়োগে কোন নজির নেই। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হি
েবে আছে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করা, হাঁচি ও কাশির সময় মুখ ঢেকে রাখা ইত্যাদি। হাঁচি ও কাশির সঙ্গে একটু ভারি তরল কণা বা ড্রপলেট ছড়ায় বিধায় আক্রান্ত রোগী থেকে নির্গত ড্রপলেটের মাধ্যমে এ ভাইরাস একজন সুস্থ মানুষের শ^াসতন্ত্রে সংক্রমিত করে। এ ড্রপলেট একটু ভারি বলে মাধ্যাকর্ষণের টানে ৩ ফুট দূরত্বের মধ্যে মেঝেতে/মাটিতে পড়ে। সে কারণে সামাজিক দূরত্ব হিসাবে ৩ ফুট নির্ধারণ করা, ঘন ঘন মেঝে পরিষ্কার করা ও সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার নির্দেশনা সংবলিত গাইড লাইন প্রচার করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা ও পরামর্শে সারাবিশ্বে একই পদ্ধতির প্রতিরোধ ব্যবস্থা চালু হয়েছে।
কিন্তু এপ্রিল ১৫, ২০২১ তারিখে বিখ্যাত গবেষণা জার্নাল ল্যানসেট-এ Ten Scientific Reasons in Support of airborne transmission of SARS-CoV-2 শীর্ষক প্রকাশনা করোনা সংক্রমণের প্রতিরোধ ব্যবস্থায় নতুন দুশ্চিন্তার জন্ম দিয়েছে। বাতাসের মাধ্যমে করোনা প্রজাতির এ মারাত্মক ভাইরাস ছড়ায় কিনা-এ সম্পর্কিত বিশ্বের ২৫টি গবেষণা পত্রের ওপর ভিত্তি করে লন্ডনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু গবেষকবৃন্দের উপরোক্ত মন্তব্য সংবলিত প্রকাশনা ছাপা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহর থেকে প্রকাশিত বিজ্ঞান গবেষণা জার্নাল ল্যানসেট ১৮২৩ সাল থেকে প্রকাশিত হচ্ছে এবং পৃথিবীর একটি অন্যতম সেরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জার্নাল হিসেবে ল্যানসেট তার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেছে। যে ২৫টি আন্তর্জাতিক গবেষণা পত্রের ওপর ভিত্তি করে ল্যানসেটে মতামত প্রকাশ হয়েছে, তার মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অর্থায়নে পরিচালিত SARS-CoV-2 and the role of airborne transmission: a systematic review শীর্ষক গবেষণাপত্র আছে।
বাতাসের মাধ্যমে কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ী করোনা প্রজাতির ভাইরাস ছড়ায়- এ মর্মে জুলাই, ২০২০ মাসে ৩২টি দেশের ২০০-এর বেশি বিজ্ঞানী তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে চিঠি লিখেছিলেন। সেখানে তারা উল্লেখ করেছিলেন যে, তাদের কাছে তথ্য প্রমাণ আছে- বাতাসে ভাসমান অতি ক্ষুদ্র তরল কণার সঙ্গে যুক্ত ভাইরাসের মাধ্যমে এ রোগের সংক্রমণ হতে পারে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার ৬ জন বিজ্ঞানী সম্প্রতি এক মতামতে প্রকাশ করেছেন যে, বাতাসের মাধ্যমে এ ভাইরাস ছড়ায় বিধায় এত সতর্কতা সত্ত্বেও ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসেনি। অক্সফোর্ড বিশ^বিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের গবেষক দল যেসব কারণ বিবেচনায় বাতাসের মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ায় বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন তা হচ্ছে-
কোভিডে আক্রান্ত ব্যক্তিদের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, বাইরের চেয়ে ঘরে অবস্থানকারী ব্যক্তিরা বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। কখনও সামনাসামনি দেখা বা কোন প্রকার সংস্পর্শের মধ্যে না থাকা ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে থাকা ব্যক্তিরা সংক্রমিত হয়েছেন। এমনকি কোয়ারেন্টাইনের জন্য নির্বাচিত হোটেলে এরূপ সংক্রমণ ঘটেছে। হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ড্রপলেট নিয়ন্ত্রণ বা সরাসরি সংস্পর্শ নিয়ন্ত্রণের সকল পন্থা অবলম্বনের পরেও পিপিই ব্যবহারকারী চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী সংক্রমিত হয়েছেন। তাছাড়া করোনা রোগী ছিল এমন কক্ষে বা করোনা রোগী বহনকারী গাড়ির মধ্যে বাতাসে এ ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। হাসপাতালে কোভিড রোগীর কক্ষে Air filter ও বাতাস নির্গমনের পথে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। সেখানে বাতাসে ভাসমান অতি ক্ষুদ্র তরল কণা (এ্যারোসল) ছাড়া একটু ভারি ড্রপলেট পৌঁছাতে পারে না। কোভিডে আক্রান্ত প্রাণীর খাঁচা দূরত্বে থাকলেও অন্য খাঁচার সুস্থ প্রাণী আক্রান্ত হয়েছে। সেখানে বায়ু ছাড়া সংক্রমণের অন্য কোন মাধ্যম ছিল না।
সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, হাঁচি-কাশি দেয় না এমন উপসর্গহীন কোভিড আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমপক্ষে এক তৃতীয়াংশ এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ৫৯% পর্যন্ত। এসব উপসর্গহীন আক্রান্ত ব্যক্তির কথা বলার সময় নির্গত অল্প কিছু ড্রপলেটসহ হাজার হাজার এ্যারোসল কণা শনাক্ত হয়েছে। সে কারণে উপসর্গহীন রোগীর কথা, হাঁচি, চিৎকার ইত্যাদির মাধ্যমে ছড়ানো এ্যারোসল বা অতি ক্ষুদ্র তরল কণার সঙ্গে এ ভাইরাস বাতাসের মাধ্যমে ছড়ানোর আশঙ্কার ভিত তৈরি করছে। এসব পর্যালোচনায় সংশ্লিষ্ট গবেষকবৃন্দ মতামত ব্যক্ত করেছেন যে, হাঁচি-কাশির ড্রপলেট ও অন্যান্য মাধ্যমে ছড়ানো বিদ্যমান ধারণার সঙ্গে বাতাসের মাধ্যমে এ ভাইরাস ছড়ানোর বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। হয়ত আরও গবেষণা করতে হবে। সে সঙ্গে সংক্রমণ নিরসনে অনেক বেশি প্রস্তুতি নিতে হবে।
করোনাভাইরাস বাতাসে ছড়ালেও আতঙ্কিত হয়ে বসে থাকার দিন শেষ। আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় এমন অনেক ভাইরাস/ব্যাক্টেরিয়ার মধ্যে আমরা বসবাস করছি বহুকাল ধরে। হাম রোগের ভাইরাস রুবেলা বা যক্ষ্মা রোগের ব্যাক্টেরিয়া ‘মায়োকর্ডিয়াম টিউবারক্লোসিস’সহ মাম্পস, চিকেন পক্স, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হুপিং কফ, ডিপথেরিয়া ইত্যাদি রোগের ভাইরাস/ব্যাক্টেরিয়া বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়। এদের মধ্যেই আমরা বসবাস করছি। করোনার এ প্রজাতির সঙ্গেও আমাদের বসবাস করতে হবে। করোনা প্রজাতির ৪টি ভাইরাস আমাদের সর্দি/কাশি বা ঈড়সসড়হ পড়ষফ-এর জন্মদাতা। করোনার ২টি প্রজাতি এখনও আছে, যা প্রাণঘাতী রোগ ঝঅজঝ ও গঅজঝ সৃষ্টি করে। তবে এখন মহামারী আকারে নেই। টিকা আবিষ্কার হয়েছে বলে করোনা সৃষ্ট কোভিড একেবারে নির্মূল হবে না, তবে মহামারী আকারে থাকবে না। মানুষের জন্য মারণঘাতী একটি মাত্র ভাইরাস পৃথিবী থেকে নির্মূল হয়েছে। তা হচ্ছে গুটি বসন্তের জন্য দায়ী ঠধৎরড়ষধ ভাইরাস। গুটি বসন্তের টিকা আবিষ্কার হয়েছে ১৭৯৬ সালে। আর এ রোগ নির্মূল হয়েছে ১৯৭৭ সালে। ব্যবধান ১৮১ বছর। পোলিও ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়েছে ১৯৫৫ সালে। এখনও পোলিও নির্মূল হয়নি। জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়েছে ১৮৮৫ সালে। এখনও জলাতঙ্কের প্রাদুর্ভাব আছে মারাত্মকভাবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়নের কারণে কোভিড রোগের ভ্যাকসিন দ্রুতগতিতে আবিষ্কার হয়েছে ও প্রয়োগ হচ্ছে। তেমনি এ রোগের মহামারী নিয়ন্ত্রণে হয়ত বেশি সময় লাগবে না। তবে নির্মূল হতে সময় লাগবে। কাজেই বাতাসের মাধ্যমে সংক্রমিত হলে এ্যারোসল প্রতিরোধী মাস্ক পরা, ঘরে আলো-বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা রাখা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাইরে চলাচল নিশ্চিত করা, বেশি সংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনাসহ আরও বেশি প্রস্তুতি নিতে হবে। সে প্রেক্ষিতে কোভিডের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা, সক্ষমতা, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন করে এ রোগের মধ্যে আমাদের জীবন এবং জীবিকা পরিচালনা ও উন্নয়নের পথে অগ্রসর হতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই।